Monday 29 January 2018

গল্প স্বপ্ন

গল্প
স্বপ্ন
চারদিকে উপচে পরা জোছনা , রেললাইনের ঠিক মাঝ বরাবর দু'পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দাড়িয়ে আছি আমি, আমার সামনেই হিংস্র একটা কুকুর, কুকুরটাকে দেখে ঠিক কুকুর বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে ভয়ংকর কোন প্রাণী। জিহ্বা বের করে রেখেছে ওটা, মুখ থেকে ক্রমাগত লালা ঝরছে। আমার দিকে যে ভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তেই সে আক্রমন করতে পারে। আশে পাসে কোন মানুষজন নেই, বহুদুর পর্যন্ত চলে যাওয়া রেললাইনের স্লিপারের উপর চাদের আলো ঠিকরে পরছে, আমার ভয় করার কথা কিন্তু ভয় পাচ্ছি না, অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। পাশাপাশি দুটো রেল লাইন, কিছুটা দূরেই একটা অচল বগি চাদের আলোর মাঝেও নিজের ভিতরটাতে অদ্ভুত এক রহস্যমময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে অন্ধকারকে আটকে রেখেছে। ওটার দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছে ভিতরে কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। আমি ওদিকটাতে যাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু কুকুরটা আমাকে কিছুতেই যেতে দিতে চাচ্ছে না । কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে আরও কতোগুলো কুকুর, তারা আমাকে বৃত্তাকারে ঘিরে ধরছে, শুধু ষ্টেশনের যাওয়ার দিকটাতে একটু ফাকা,আমি চাইলে সে দিক দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারি। ষ্টেশন এ পৌছেও যে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না সেটা স্পটই বুঝতে পারছি তবুও কেন জানি না আমি সেদিকটাতেই দৌড়তে লাগলাম, আশ্চর্যের বিষয় আমি দৌড়ানো শুরু করার সাথে সাথেই ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে আরও কতো গুলো ভয়ংকর তাগড়া কুকুর বেরিয়ে এলো, তারা সবাই মিলে আমাকে ধাওয়া করতে লাগলো, আমি প্রাণপণ দৌড়াতে লাগলাম। চাদের আলোতে সব কিছু এত স্পট দেখা যাচ্ছে যে আমি খুব ভালো ভাবেই আমার গায়ের আকাশী রংয়ের শার্ট আর কালো পান্টা দেখতে পাচ্ছি। স্টেশনে কোন আলো নেই, গাঢ় অন্ধকার , তারচেয়ে বরং বাইরে খালো আকাশের নীচেই সব কিছু ভালো দেখা যাচ্ছে তবুও আমি ষ্টেশনের দিকে ছুটছি, আমি যতই দৌড়চ্ছি কুকুরের দলটাতে ততোই চারপাশ থেকে আরও অগুনিত কুকুরে এসে যোগ দিচ্ছে। ছুটতে ছুটতে আমি অনুভব করলাম আমার সাথে চাদর দিয়ে সমস্ত দেহ আবৃত্ত করে আরও একজন দৌড়াচ্ছে,আমি ঘামছি, ঘামতে ঘামতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নিজেকে আমার নরম বিছানার মধ্যে আবিষ্কার করলাম।
ঘুম ভেঙ্গে খুব অবাক হলাম, এই স্বপ্নের মধ্যে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা আছে, কিন্তু সেই অস্বাভাবিকতা আমি ধরতে পারছি না , কি হতে পারে?
কিন্তু আমার ভেতরে কে যেন বলছে এই ঘটনা বাস্তব, একদিন না একদিন আমি এই ঘটনার সম্মুখীন হবো, স্বপ্নটা কতটা অদ্ভুত ছিলো জানি না কিন্তু আমার কাছে খুবই অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর স্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম।
আজ শশীর সাথে দেখা করতে গাজীপুর যাওয়ার কথা, কলাবাগান থেকে গাজীপুর যেতে আসতে সারাদিন লেগে যাবে। যতদ্রুত সম্ভব রওনা হওয়া দরকার। গামছা আর কাপড় চোপড় নিয়ে গোছলে চলে গেলাম।
নাস্তা সেরে চা খেতে খেতে মনটা কেমন যেন খচখচ করছিলো, শশীর সাথে দেখা করতে আজকেই যাওয়াটা কি ঠিক হবে? স্বপ্নটা যে করেই হোক আমার জীবনে বাস্তবায়িত হবে, আমি নিশ্চিত। কিন্তু কি করে? আজই কি?
হঠাৎ করেই আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম।
এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়তে স্বপ্নটাই আমাকে সাহায্য করলো।
গল্প
স্বপ্ন-২ পর্ব
চারু জানালার পাশে বসে এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। গ্রাম গুলোতেও এখন নিরবতা নামের জিনিসটা হারিয়ে গেছে। বাড়ির সামনে কিছুটা ফাকা জায়গা, বাবা সেখানে বাগান করেছেন , বাগানটার পাশ ঘেষেই চলে গেছে একটা পাকা রাস্তা, ক্রমাগত সেখান থেকে একটার পর একটা ট্যাম্পু রিক্সা ছুটে চলেছে। চারুর শব্দ ভালো লাগে না,তার নিজের মাথার মধ্যেই কতগুলো লোক সব সময় কথা বলে, চারুর মনে হয় মানুষ গুলো যেন তাকে সব সময় চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। তাকে নিয়ে উপহাস করছে, হাসছে সবাই, চারু তার চারপাশে হাসির শব্দ শুনতে পায়, উপহাসের হাসি! লোকগুলো সব সময়ই তাকে নিয়ে কথা বলতে থাকে, চারু তাই নিজে কথা বলে না, ঝিম মেরে থেকে ওদের কথা শোনে আর হাতের কাছে শক্ত কিছু পেলে ওদের উদ্দেশ্য সেগুলো শূন্যে ছুড়ে মারে। বাইরের শব্দ তাই চারুর সহ্য হয় না, মনে হয় বাইরে থেকে শব্দ আসলে ও আশেপাশের লোকগুলোর কথা শুনতে পাবে না, তখন ওরা চারুর নামে যা খুশি তাই বলে ফেলবে, কিন্তু চারু ওদের কে তার নামে আজেবাজে কথা বলতে দিবে না, কিছুতেই না । শব্দ শুনলেই তাই চারুর মাথার ভিতরের পোকাটা নড়েচড়ে ওঠে, ইচ্ছে সব কিছু তছনছ করে দিতে । রাগে ক্ষোভে নিজেকে এবং সেই সাথে আশেপাশের সব কিছুকে ছিঁড়েখুঁড়ে তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে। চারুর তখন মাথা ঠিক থাকে না, হাতের কাছে যা পায় সব ছুড়ে মারে, মোটামুটি এই ঘরের সব কিছু ভাঙ্গা হয়ে গেছে অবশিষ্ট বলতে কিছুই নেই। দরজাটা সব সময় বাইরে থেকে তালা লাগানো থাকে। খাবারের সময় হলে মা শুধু দরজা খুলে খাবার দিয়ে যায়, চারু সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। মাকে খামছে দিয়ে, কিল ঘুষি দিয়ে আহত করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চায়। চিৎকার করে বলে - তোমরা আমাকে পাগল ভেবেছো? আমি পাগল? আমি পাগল? অপূর্বকে আমার কাছে এনে দাও, আমি ওকে নিজ হাতে খুন করবো, অপূর্বকে খুন করবো আমি।
কলাবাগান থেকে গাজীপুর পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা প্রায় একটা বেজে যায় । নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছি , শশীর সাথে আজ অনেক দিনপর দেখা হবে, নানান ঝামেলায় এতদিন ওর সাথে দেখা করার সময় হয়নি । আজ প্রায় একমাস হয়ে গেলো শশীকে দেখি না ।আমার এই বন্ধুর বাসায় আগে মাঝে মাঝেই শশীর সাথে দেখা করতে আসতাম । শশীকে কি ভাবে ভালোবেসে ফেলেছি, অথবা এটা আসলেই ভালোবাসা কি না? এখনও সন্দেহ আছে অামার মনে, তবুও শশীকে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না আমার , প্রচন্ড আকর্ষন অনুভব করি। এই তীব্র আকর্ষণ আমাকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
গাড়িটা পার্ক করে নিয়াজের বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল চেপে দম বন্ধ করে দাড়িয়ে আছি , শশী যখন দরজা খুলে সামনে এসে দাড়ালো আমার মনে হলো আসলেই আমার সামনে চাঁদ ঝলমল করে উঠলো।
নিয়াজ বাসায় নেই ওর স্ত্রীও নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে। দরজাটা বন্ধ করে সোজা সোফায় গিয়ে বসলাম , শশী তার ঝলমলে সৌন্দর্য আর শরীরের মনমাতানো ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে আমার খুব কাছে এসে সোফার একটা হাতলে আলতো করে বসে খুব আদুরে কন্ঠে জানতে চায় -অপূর্ব, চা কফি কিছু খাবে? আমি বানিয়ে আনি?
শশীকে দেখলেই আমি আগের মতোই মাতাল হই, ওকে দেখলে কেউ বলবে না তার দুটি সন্তান আছে। সৌন্দর্য আর শরীরের গড়ন এমন ভাবে চর্চার মাঝে ধরে রেখেছে সে যে যেকোন পুরুষেরই শশীকে দেখলে শরীরে আগুন ধরে যাবে, আর সেই আগুনে ঘি ঢালতেও শশী খুব ওস্তাদ।
শশীর স্বামী বিদেশে থাকে , স্ত্রীকে দেওয়ার সময় মতো কোথায় তার? আর শশীও জানে তার চাহিদা কি ভাবে পূরণ করে নিতে হয়।
অপূর্বকে প্রথম দেখাতেই মনে ধরেছে শশীর। সুন্দর সুঠাম দেহ, লম্বা,ফর্সা । শশীর বোধ হয় এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই। আজ এতদিন পর অপূর্বকে কাছে পেয়ে শশী তাকে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পেতে চাইল।
আমি শশীর দিকে তাকিয়ে বললাম - চলো আজকে তোমাকে আমার ফ্লাটে নিয়ে যাবো।
শশী সত্যই খুব অবাক হলো, আসলেই অপূর্ব তাকে নিজের ফ্লাটে নিয়ে যেতে চায়, অদ্ভুত তো!
লম্বা পথে যেতে যেতে শশীর সাথে আমার খুব একটা কথা বলতে ইচ্ছে হলো না , নিজের মধ্যই কিছু একটা হিসেব মেলাতে ব্যস্ত এখন আমি।
শশীকে খুব উৎফুল্ল মনে হয়, তার এতো দিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হতে যাচ্ছে, চারুর সাজানো সংসারটা এবার বোধ হয় তার নিজের দখলে চলে আসবে, চারু শশীর বান্ধবী। কেন যেন শশীর সব সময়ই চারুর সুখ দেখলে হিংসে হতো। চারুর বিয়ের আসরে শশী যখন প্রথম অপূর্বকে দেখে, মনে মনে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরেছিলো সে। চারুর বর যেমন দেখতে সুন্দর তেমনই শিক্ষা অর্থে বিত্তে সব দিক দিয়েই সেরা।
নিজের ভাগ্যের সাথে চারুর ভাগ্যকে মিলিয়ে কোন ভাবেই নিজেকে বিজয়ী মনে হয় নি শশীর।
শশীর বর শশীর চেয়ে বয়সে অনেক বড়, শুধু মাত্র সুন্দরি বলেই শশীকে তার বউ করে নিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু শশীর চাহিদা গুলো পূরণ হয় নি সেখানে। আর স্বামী দূরে দূরে থাকায় নানা রকম পরিস্থিতি সামলাতে সামলাতে শশী নিজেও অন্য রকম হয়ে গেছে । নিজের চাহিদা গুলো পূরণ করার জন্য যে কোন কিছু করতেই শশীর আত্মসম্মানে বাধে না এখন আর। প্রথম দেখাতেই যখন অপূর্বকে মনে ধরেছিলো তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলো শশী যে করেই হোক অপূর্বকে তার চাই ই চাই।
নিজের সুখ স্বপ্নে বিভোর শশীর ধারনাই ছিল না আজ তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে। অন্যের ঘরে আগুন দিলে তার আঁচ যে নিজের গায়েও লাগে শশীর তা জানা ছিলো না।
গল্প
স্বপ্ন-শেষ পর্ব
চারুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চারুকলায়, ওর ছবির প্রদর্শনী চলছিলো, আমি আমার চারুকলার এক বন্ধু রনির সাথে ওখানে গিয়েছিলাম,চারু রনির বন্ধু। এক আড্ডায় রনি, চারু ও আরও কয়েক জনের সাথে আমিও ছিলম , মুগ্ধ চোখে চারুকে দেখছিলাম।
এরপর যখনই সুযোগ পেতাম রনিকে খুজতে চারুকলায় চলে যেতাম, আসলে রনি তো ছিলো বাহানা, চারুই ছিলো আমার আসল উদ্দেশ্য। যতই চারুকে দেখেছি ততোই মুগ্ধ হয়েছি, ওর মত মেয়ের আমাকে ভালোবাসার কথা না, অন্য জগতের মানুষ চারু।
আমি চারুকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলাম। চারুকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করতে আমার খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয় নি।
চারুর প্রতি আমার ভালোবাসাটা অন্য রকম, সেখানে চোখ ধাধানো কোন ব্যাপার নেই।
কিন্তু শশীর প্রতি কি করে যে আমি এত দুর্বল হয়ে পরলাম জানি না। শশী চারুর খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। প্রায়ই আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। আমি, শশী আর চারু তিন জনে মিলে আড্ডা দিতাম রাতভর। কথা কথার গায়ের উপর হেসে গড়িয়ে পরা, চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে আঙ্গুলে ছুয়ে দেওয়া, শশীর চোখের মোহিনীশক্তিতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম ক্রমশ। একটা বিষয়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, আমাদের মাঝে যা-ই ঘটুক না কেন চারু সেগুলো কখনই বুঝতে পারবে না, কারন চারু সব সময়ই ছিলো আত্মভোলা, ছবি আকা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো সে, কতদিন এমন হয়েছে যে, শশী আর আমাকে একসাথে গল্প করতে রেখে মাঝ রাতেও সে চলে গেছে তার অসম্পূর্ণ ছবিটা শেষ করতে,আর এই সুযোগে আমি আর শশী নতুন করে ছবি একেছি আমাদের কামনা বাসনার, অনৈতিক আকাঙ্ক্ষার। ঘন্টা খানেক পরে ফিরে এসেও আমাকে আর শশীকে খুব কাছাকাছি গল্পে মশগুল থাকতে দেখেও চারুর মনে একবারও কোন সন্দেহ জাগে নি বরং হাতে করে তিন কাপ চা নিয়ে এসে হাসি মুখে আবার আড্ডায় যোগ দিয়েছে সে।
সব কিছু ভালোই চলছিলো। একদিকে চারুর গভীর ভালোবাসা, সুন্দর করে সাজানো গোছানো সংসার, চারু ফ্লাটটাকে সাজিয়ে ছিলো তার মনের মাধুরী দিয়ে,সব জায়গাতেই চারুর সুন্দর রুচির ছাপ ছড়িয়ে ছিলো, সে তার ভালবাসা আর স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়ে ছিলো আমাদের বিশাল বড় ফ্লাটটা। একদিকে চারুর নির্মল ভালোবাসা অন্য দিকে শশীর জন্য আমার মনের মাদকতা। কোন চাহিদা পূর্ণ হতেই কোথাও কোন বাধা ছিলো না, যখন তখন শশী চলে আসতো আমাদের বাসায়, হয়তো চারু বাসায় নেই ছুটির দিনে ঝিম দুপুরে আমি তখন বিছানায় শুয়ে আরামে গা এলিয়ে দিয়েছি শশী তখন উড়ে এসে হাজির, ব্যবসার কাজে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা বলে শশীকে নিয়ে আশেপাশের রিসোর্ট গুলোতে দুতিনদিন কাটিয়ে ফিরে আসতাম ফুরফুরে মেজাজে। আমি জানতাম এসব বোঝার মতো মন চারুর কখনই হবে না, এতো সুক্ষ বুদ্ধি চারুর নেই।
কিন্তু এক পর্যায়ে এসে সমস্যা বাধলো, সমস্যার শুরু হলো তখন যখন চারুর এক খালা জরুরি দরকারে আমাদের কাছে এসে কিছুদিনের জন্য থাকা শুরু করলেন। তিনি শশীর যখন তখন আমাদের বাসায় আসা, রাতে থেকে যাওয়া, সারারাত আড্ডা দেওয়া এসব কিছু ভালো নজরে দেখলেন না। আমি দেরীতে বাসায় ফিরলে তিনি নানান প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। কথায় বলে না সূর্যের চেয়ে বালি গরম,বিষয়টা অনেকটা তেমন হয়ে দাড়ালো।
আমি বুঝলাম চারুর মনে ধীরে ধীরে সন্দেহ বাড়ছে, সেও বিষয় গুলোকে এখন আর সহজ ভাবে নিচ্ছে না।
শশীকে নিয়ে একবার সিলেটে এক রিসোর্টে গেলাম। সেখানে চারুর কোন স্কূলের বন্ধু কর্তব্যরত ছিলো। আমি তাকে চিনতে পারি নি, শশীও চিনতো না। সে ছিলো চারুর স্কূল জীবনের বন্ধু, ফেসবুকে সে চারুর সাথে আমার ছবি দেখেছিলো। কোন এক ফাকে আমার আর শশীর অন্তরঙ্গ কিছু ছবি তুলে ইনবক্সে পাঠিয়ে দিয়েছিলো সে চারুকে । সিলেট থেকে ফিরে আসার পর চারুকে দেখলাম উন্মাদের মতো। সে আর আগের মতো নেই, সব কিছু নিয়ে খুব ঝামেলা বেধে গেল, অনেক কষ্টে হাজারবার ক্ষমা চেয়ে, শশীর সাথে আর কখনও যোগাযোগ রাখবো না প্রতিজ্ঞা করে সে যাত্রায় রক্ষে পেলাম।
কিন্তু পাপে যাকে একবার ধরে তাকে কি আর সহজে ছাড়ে? শশীও আমাকে ছাড়তে চাইলো না। জীবনে সে অনেক পুরুষেরর ভালোবাসা পেয়েছে কিন্তু আমার মতো করে সে না কি কাউকেই ভালোবাসে নি, আমাকে সে না - কি কোনদিন ভুলতে পারবে না। কতোদিন দূরে দূরে থাকার পর আমরা আবারও কাছে এলাম।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শশীকে আমার আর ভালোলাগছিলো না, ওর প্রতি আকর্ষণ আমার চাহিদাগুলো পূরণ হওয়ার সাথে সাথেই ক্রমশ কমে আসছিলো।
আর এক্ষেত্রে শশীর বেলায় হচ্ছিলো ঠিক তার উল্টো। আমি যতোই এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিলাম শশী ততোই আমাকে চোরাবালির মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো আরও অতল গহ্বরে।
এত কিছুর মাঝে চারু ভালোবাসা না বাসার দোটানায় দুলতে দুলতে আমার কাছে কখনও আসতো আবার কখনও ছিটকে দূরে সরে যেতো। আমাদের সম্পর্কটা আর কিছুতেই আগের মতো হচ্ছিলো না, তবুও একদিন আমাদের জীবনে সেই সুসংবাদ এলো, যে সংবাদ শোনার জন্য আমি আর চারু উন্মুখ হয়ে ছিলাম। আমরা জানলাম আমাদের সংসারে আসছে কোমল ছোট দুটি হাতের ছোট একটা পুতুল। আমি নিজেকে বদলে ফেলতে চাইলাম কিন্তু শশী কোন মতেই তা হতে দিচ্ছিলো, সিলেটের ঘটনা জানার পর শশীর আমাদের ফ্লাটে আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো চিরদিনের জন্য । কিন্তু এরই ফাকে আমি যে কয়বার শশীর সাথে দেখা করেছি সব কিছু সে চারুকে নিজে জানালো এবং চারুকে বললো আমি শশীকে ভালোবাসি চারু যেন শশীর আর আমার জীবন থেকে দূরে সরে যায়।
এই ঘটনার পর চারু আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, আমি চারুকে বাচাতে পারলেও আমাদের অনাগত সন্তানকে বাচাতে পারিনি। চারু গত একমাস ধরে তার বাবা মার কাছে আছে। আমাকে সে চিনতে চায় না, সে এখন আমার অচেনা।
ভুল গুলো সব আমার। তাই আমি নিজেই সেই ভুলের সংশোধন করবো।
আজ শশী খুব খুশি, আমার জীবন থেকে চারু নামটা দূরে চলে গেছে, সব কিছু তার দখলে।
কলাবাগানের ফ্লাটে পৌঁছতে পৌছতে রাত দশটা বেজে গেল।পথে দোকানে থেমে আমি কিছু লবন, ব্লিচিং পাউডার আর কস্টেপ কিনলাম। শশীকে নিয়ে বাইরে রেস্টুরেন্ট থেকেই রাতের খাবার সেরে এসেছি। শশী রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ছুটির দিন হলে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, দামি দামি উপহার পেতে খুব পছন্দ করে। শশীর গত জন্মদিনে ওকে কিনে দেওয়া ডায়মন্ডের দুলটা এখনও ওর দু'কানে চিকচিক করছে। ওকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে, যে কোন পুরুষ ওকে দেখে মুগ্ধ হয়, কিন্তু মুগ্ধতা দিয়ে কি জীবন চলে?
একবার ডেঙ্গু হয়ে আমি হাসপাতালে বিছানায় যখন পরে ছিলাম তখন দেখেছি চারুর চোখে সে কি আকুলতা! শুধু উত্তল উন্মাদনা দিয়ে কি জীবন চলে? চলে না।
শশী সমস্ত ফ্লাটে ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছে এতক্ষণ,কিছুক্ষণ আগে আমি নিজ হাতে রান্না ঘরে গিয়ে চারুর আড়ং থেকে কেনা শখের চায়ের কাপে করে চা বানিয়ে এনে দুজনে মিলে চা খেয়েছি।
চারুর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে রাতে শোবার আগে শেষ বারের মতো দেখে নিয়ে শশী (চারুর) আমাদের শোবার ঘরের বিছানাটায়, চারুর বিছানায় কি নিশ্চিন্তে আমার কোলে মাথা রেখে গা এলিয়ে দিলো। খুব বেশি সময় লাগলো না শশীর অতল ঘুমে তলিয়ে যেতে। চারদিকে শুনশান নিরাবতা, দূরে একটা কুকুর একটু পর পর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ডেকে উঠছে, দুএকটা গাড়ি মাঝ রাতে ঘরে ফিরছে। আমি শশীর দেহটা কোলে তুলে নিয়ে যাই লাগোয়া বাথরুমটায়, সেখানে আগে থেকেই একটা বড় ড্রাম এনে রেখেছিলাম, কয়েকদিন আগে ওটা স্টোর রুমে খুজে পেয়েছি। শশীর শরীরটা ছিপছিপে, একতিল মেদ নেই, আমি ওর দেহটা অনায়াসে ড্রামের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলি, একটা ধারালো ছুরি ওর গলায় ছুইয়ে একটা টান দিতেই ফিনকি দিয়ো রক্ত ছুটতে থাকে। শশীর শরীরের উপরে ইচ্ছে মতো লবন আর ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে থাকি, যেন খুব দ্রুত ওর শরীরটা পচন ধরে কিন্তু ব্লিচিং পাউডারের কারনে গন্ধ না ছড়ায় , তারপর ড্রামের মুখটা লাগিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়ে কস্টেপ দিয়ে মুখটা পেঁচিয়ে আটকে দেই যেন বাতাস চলাচল করতে না পারে। সব কাজ শেষ হলে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বাথটাবে গা ভিজিয়ে আরাম করে গোসল শেষ করে শুতে যাই।
কাল আমার ফ্লাইট। চলে যাবো দূরে কোথাও, তারপর সেখান থেকে অন্য কোন দেশে, সেখান থেকে অন্য কোথাও। নিজের থেকে পালিয়ে যাবো দূরে বহু দূরে...
বেশ কিছুদিন পর চারুদের ফোনটা বেজে ওঠে, চারুর মা আফরোজা বেগম ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অপূর্বর গলা পাওয়া যায় - মা আমি অপূর্ব। চারুকে বলবেন ওর শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে শশীর মৃতদেহ বড় একটা ড্রামের মধ্যে রেখে এসেছি, ও যেন শশীর বাবা মাকে খবর দেয়, তারা যেয়ে মৃতদেহটা উদ্ধার করুক।
চারুর কানে যখন খবরটা পৌছায় এসব কিছু বোঝার ক্ষমতা তখন তার অবশিষ্ট নেই।
বেশ কয়েক বছর পর চারুর যত্নে সাজানো ফ্লাটটা ভাড়া নিতে আসেন ডালিয়া, বাসাটা তার খুব পছন্দ হয়, এত সুন্দর ফ্লাট, এমন সাজানো গোছানো, কেন যে এত বছর অব্যবহৃত অবস্থায় পরে ছিলো কে জানে? ডালিয়া ফ্লাটটা ভাড়া নিয়ে খুব খুশি হন, এত কম ভাড়ায় কলাবাগানে এমন একটা ফ্লাট পেয়ে যাবেন ভাবতেই পারেন নি তিনি। কিন্তু ফ্লাটে ওঠার দুই মাসের মাথায় তিনি ফ্লাট ছেড়ে চলে যান।
সত্যিই চারুর সাজানো সংসারটা বোধ হয় এতদিনে শশী নিজের করে পেলো।

No comments:

Post a Comment