Monday 29 January 2018

কাঁকড়বিছানো রাস্তায় ঘষটে হাঁটার শব্দ পেয়ে ঘুমটা টুঁটে যায়।

কাঁকড়বিছানো রাস্তায় ঘষটে হাঁটার শব্দ পেয়ে ঘুমটা টুঁটে যায়। টেবিল ল্যাম্পটা জালালাম। সবকিছু ছিমছাম। ঘরটা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা গরম। একটা চাপা নিশ্বাসের শব্দ রয়ে-শয়ে কানে আসছে। বাসায় কেউ নেই। সবাই বেড়াতে গেছে- নানা বাড়ি।
রাতে ঘুম ভাঙলেই পেশাব চাপে। শীতের রাতে বিছানা ছেড়ে উঠাকে, অন্নপূর্ণার চূড়ায় আরোহনের মতো লাগে। পেশাব এমন এক বদখৎ জিনিস, চাপলে আর রক্ষা নেই। কোথায় শুনেছিলাম- পেশাপ চাপলে আর তা নির্গত করতে না চাইলে- নিজের প্রিয়তমার মুখ কল্পনা করতে হয়। বহু চেষ্টা করেও পারিনি। কল্পনা করতে চাই মৃণ্ময়ীর মুখ এসে পড়ে শর্মিলীর চেহারা। শেষে উঠে যাই।
জানালার কাঁচে কুয়াশা জমে জমে সুন্দর একটা অবয়ব তৈরি করেছে। প্রকৃতি এক আজব কারিঘর। যখন যা ইচ্ছা করে তাই সামনে নিয়ে আসে। ওয়াশরুম থেকে আসার পরে টুপুর টুপুর পানি পড়ার শব্দটা কানে আসে। বিরক্তিকর শব্দ। দুইবার উঠে গিয়ে ট্যাপগুলো চেক করে এসেছি। তবু শব্দটা আসছে। অন্যকিছু নয়তো! খট করে একটা শব্দ এল রুমের বাহির থেকে। তড়াক করে উঠে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিলাম।
বাসার প্রধান দরজা-টা হাট করে খোলা। কিছুটা অবাক হলাম, সাথে ভয় লাগতে শুরু করছে। যদিও বাসার নিচে দারোয়ান আছে। ঘুমানোর আগে-তো আমি দরজা জানলা সব চেক করেই ঘুমিয়েছিলাম! নাকি করেনি। স্পষ্ট মনে আছে-টিভি অফ করে দেয়ার পরে দরজা এসে লাগিয়েছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে খেয়াল করলাম, বাথরুম থেকে এখন আর শব্দটা আসছেনা। দরজাটা বন্ধ করে লাইট অন করেই শুয়ে পড়লাম।
টিকটিক করে দেওয়াল ঘড়িটা সময়ের স্রোত বয়ে চলছে। কাটাগুলো কি সাবধানে সময় নিয়ে চলে যাচ্ছে অতীতের পথে! সেই পথে হেঁটে হেঁটে আমরা সামনে চলছি। এগিয়ে যাচ্ছি। মানুষ ভয় পেলে নাকি উচ্চমার্গীয় কথা কথা আসে মনে। আমারো তাই হচ্ছে। কিন্তু ভয় পাবার কি কারন আছে!
বাহিরে ভারী হয়ে শিশির পড়ছে। বাতাবীলেবু বাগান থেকে একটা মোহনীয় গন্ধ জানালার ফাঁক ফোকড় গলে বদ্ধ উষ্ণ রুমটাকে মায়াময় করে তুলছে। আমার হাতে “বকুলফুল”। রাতে ঘুম না আসলে আমার বই পড়ার অভ্যাস। বইয়ের পাতা উল্টানোর সাথে সাথে একটা টুংটাং শব্দ আসে। একবার চোখ তুলে তাকালাম জানালার কাঁচে। প্রথমে ভাবলাম আমার বিভ্রম। ভালো করে তাকালাম- চোখ জুড়ানো এক রমণীর ছবি আঁকা শিশিরে। কাঁচের চোখ গুলো দিয়ে জল পড়ছে, কিন্তু মেয়েটির মুখে হাসি। মায়াবতীরা এমন করে হাসে। মেয়েটি কি মায়াবতী। নাকি শুধু মায়া!!!
জলের শব্দ কানে আসছে। একটু একটু করে শব্দের মাত্রা বাড়ছে। কাছ থেকে। খুব কাছ থেকে আসছে ছড়ছড় শব্দ। বইটা বন্ধ করে দিলাম। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখি। ফ্লোরে জলের বন্যা। পায়ের পাতা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে। ওয়াশরুমের দরজা-টা ভিড়ানো। ওটার ফাঁক গলেই জলের স্রোত আসছে।
বালতি-টা জলে টইটুম্বুর। সেখানে একটা মেয়ে মানুষ মাথা ডুবিয়ে রেখেছে উবু হয়ে। তার কালো চুল জলের উপরে ভাসছে। ভয়ে হাত-পা কেঁপে যায়। দরজা-টা বাহির থেকে টেনে লাগিয়ে দিলাম তৎক্ষনাৎ। ধুমধুম করে চাপড় পরে। আমার পাগলের মতো হয়ে যাবার দশা। জানালার কাঁচে যে ছবিটা আঁকা দেখলাম, তা নেই। কেউ মুছে দিয়েছে হাত দিয়ে। একটা পাঞ্জার ছাপ স্পষ্ট।
দরজা ভেঙ্গে ফেলবে এমন আওয়াজ বেড়েই চলছে। শিড়দাড়া বেয়ে ঠান্ডা শিহরণ বেয়ে যাচ্ছে। শব্দটা বেশক্ষণ পরে থেমে গেল। দরজা খুলে দেখি- ভেতরে কিচ্ছু নেই। কেউ নেই। জলের রেশ মাত্র নেই। সবকিছু কি আমার মনের ভুল! এ হতেই পারেনা। পায়ের দিকে তাকালাম- ভেজা না। ফ্লোর একদম শুকিয়ে আছে।
ওয়াশরুমে রাখা আয়নার দিকে তাকালাম। নিজেকে আজকে অন্যদের চেয়ে সুন্দর লাগছে। অহেতুক ভয় পাওয়ার কারনে নিজে নিজেই হাসলাম। একটু পরেই দম বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা চিৎকার শুনলাম। আমি অচল হয়ে আয়নার সামনেই দাড়িয়ে রইলাম সম্মোহিতের মতো। ঘাড়ে কিছু একটার নিশ্বাসের মতো লাগল। পিছনে তাকালাম! নাহ কিচ্ছু নেই। আবার আয়নায় মুখ করে তাকিয়ে তবদা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা- যে মেয়েটাকে জানালার কাঁচে দেখলাম। সেই মেয়েটা এখন আমার পিছনে ঠায় দাড়িয়ে। মাথা ভর্তি কুচকুচে চুল। পীতবর্ণের চোখ থেকে জল পড়ছে ক্রমাগত। সেই মিষ্টি হাসিটাও লেগে আছে। মেয়েটাকে আমার খুব চেনা মনে হলো। তার চোখ মুছে দিতে ইচ্ছে হলো।
আয়না-টা ফুড়ে যেন রক্ত ছিটকে আসছে। আয়নাটায় চেপে ধরলাম। কাজ হলোনা। রক্ত বেরুচ্ছে। পরক্ষণেই দেখলাম- আমার কপাল বেয়ে গরম রক্ত বের হচ্ছে। সেখানে কোন যন্ত্রনা নেই, ব্যথা নেই। ভয় পেয়ে গেলাম। রক্ত বন্ধ হচ্ছেনা। পিছনের দাঁড়ানো মেয়েটার ঠোঁটে ক্রূর হাসি ফুটল। পিছনে তাকাতেই শূন্যে মিলিয়ে গেল। রক্তে হাত ভিজে যাচ্ছে। মেঝেতে টপটপ রক্তের শব্দ। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সদর দরজা দিয়ে বাহিরে যেতে উদ্যত হতেই- কিসের রক্ত! কিচ্ছু নেই। আড়চোখে জানালায় তাকালাম। সেখানে অষ্টাদশী তরুণী হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।
দরজায় লাথির শব্দে ঘুম ভাঙছে। মানুষের ভদ্রতা বলতে কিছু নেই। কলিংবেলের পাশাপাশি ক্রমাগত লাথি দিয়েই চলছে দরজাতে। একজন নয়। অনেক মানুষের কথা কানে আসলো। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে একদল পোষাকধারী ঘরে ডুকল, তাদের সাথে এ বাড়ির সকল বাসিন্দাকে চোখে পড়ল। বাহিরে পাড়াশুদ্ধ মানুষের ভিড়। চিৎকার। চেঁচামেচি।
উপরতলায় খুন হয়েছে। বাথরুমে লাশ পড়ে আছে। গলা কেটে খুন করে পানির বালতিতে মাথাটা ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ এসেছে তদন্ত করতে। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমি বাকি ছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে এখুনি। মাথাটা বরফ শীতল হয়ে আছে।অনুভবগুলো কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছেনা। একটা ভোঁতা অনুভূতি। একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট পাফ করতে পারিনা। এমনি ধরিয়ে বসে থাকি।
বাসাটা খনকিছুর মধ্যেই পোষাকধারীরা তছনছ করে ফেলছে। টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানিটা ইচ্ছে করে ছুড়ে মেরেছে। সেখানে ছুড়ি কাঁচি লুকিয়ে থাকতে পারে ভেবে হয়ত। আমি নির্বিকার। নির্মলা থাকে উপরতলায়। বাসায় কি জানে ঝামেলা করে এই বাড়িতে উঠেছে। একটা প্রাইভেট ফার্মে মোটা বেতনে চাকরি করে।
‘ওখানে হাত দিয়েন না’।
চারজন পুলিশ ভূত দেখার মতো চমকে উঠল যেন। প্রায় একসাথে বলল ‘কেন?’
‘আচ্ছা দিন। দেখুন কি আছে। এখন আপনারা যা বলবেন তাই হবে। করুন যা ইচ্ছা’।
বাড়ির অন্য বাসিন্দারা এর-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বিছানার কোণ থেকে পুলিশেরা স্কোরের কিছু অব্যাবহৃত প্যাকেট খুঁজে আনল। তাদের চোখে মুখে সপ্তাশ্চর্য দেখার আনন্দ মনে হলো। বাসিন্দাদের কেউ কেউ লজ্জায় মুখ ডাকলো। মহিলা যারা এসেছিল- তারা শাড়ির আচলে মুখ আড়াল করল। কমবয়সীদের চোখে একটা চাপা হাসির দমক দেখলাম। সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে এল। তদন্ত কর্মকর্তার চোখ আগুনে লাল। মনে হলো প্রেশার উঠে গেছে চোখে। রক্ত জমে আছে। চোখগুলো গেলে দিয়ে রক্ত বের করে দিতে ইচ্ছে হলো।
‘এই গুলো কি?’
‘আপনি ব্যাবহার করেন না বুঝি’?
পাল্টা প্রশ্নে কনস্টেবলদের মুখে হাসি চলে আসলেও ইন্সপেক্টরের মুখ আরো থমথমে হয়ে এল।
‘হারামজাদা! এইগুলি কি? তুই না বিয়া করস নাই’।
‘নবাবের পুত্রদের নবাবজাদা, সাহেবের ছেলেপুলেদের সাহেবজাদা বলে। আমার বাপ হারাম খেয়ে পেট ফুলায় না। তাই আমি হারামজাদা নই। এইগুলো কনডম। বিয়া না করলে কনডম ব্যাবহার করা যাবেনা, তা কি এই প্যাকেটে লিখা?’
তদন্ত কর্মকর্তা করিৎকর্মা লোক। তিনি প্যাকেটের গায়ে কি কি লেখা আছে তাতে চোখ বুলাতে শুরু করলেন।
হাসি পেল খুব। চেপে রাখলাম। কারন আমার সামনে দাঁড়ানো যে পুলিশ কর্মকর্তা আছে, তিনি যথাসম্ভব মোটা বুদ্ধির। পুলিশের হাত চিতা বাঘের মতো। খপ করে ধরেই প্যাঁদানি শুরু করে দিবে।
বাড়ির অন্য সকলের সাথে আমিও এসে দাড়ালাম নির্মলার ফ্ল্যাটে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে জলের বালতিতে। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ কাউকে হাত দিয়ে দেয়নি। রক্ত আর জল মিশে একটা অদ্ভুত রং তৈরি হয়েছে। কাচা হলুদের চেয়ে একটু কড়া রং। কচুরিপানার ঝুরির মতো চুলগুলো তার ভাসছে। হাত দিয়ে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটা নির্মলা। কণ্ঠনালীর ঠিক নিচে বাম দিকে একটা তাল তিল আছে ওর। চুমু খেতে ইচ্ছে করলো। অনেকগুলো উৎসুক চোখ চেয়ে আছে তার দিকে।
নিচ থেকে এক কনস্টেবল চিৎকার করছে। সে কিছু একটা পেয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা পড়িমড়ি করে ছুটে যাচ্ছে। তার সাথে ছুটে চলছে বাড়ির অন্য সকলে। আমি একা নির্মলার পাশে। তাকে ছুইতে ইচ্ছে করছে। খুব করে তার পুরুষ্ট ঠোঁট কামড়ে দিয়ে কামনার ঝড় তুলে দিতে ইচ্ছে করছে। তাকে কি কোন অনুভূতি ছুইবে? না ছুইবে না। সে হারিয়ে গেছে আমাবশ্যার চাঁদের মত। আমি জানি পুলিশ, পাড়ার লোক- বাড়ির বাসিন্দারা সবাই এখন আমার রুমে। আমি জানি তারা কি দেখছে। কি খুঁজে পেয়েছে পুলিশ তাও জানি।
জানালার কাচা শিশিরে আঁকা নির্মলার ছবি দেখছে অনেকজোড়া চোখ। নির্মলা এখন আমার কোলে। আমি তার চোখ দেখছি। একজোড়া শান্ত চোখ। সেই চোখে কোন অবিশ্বাস নেই!
ছবি
মনোয়ারুল ইসলাম
জানুয়ারি ২৯, ২০১৭

No comments:

Post a Comment