Monday 29 January 2018

মুরগীর রান বিড়ম্বনা

মুরগীর রান বিড়ম্বনা
আমার ছোটবেলার খাদ্যাভ্যাসের একটা বড় অংশই কেটেছিল,মুরগীর রান খেয়ে।এখন বড় হয়ে যাওয়ার পরও মুরগীর রান খেতে গিয়ে প্রচুর বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে, হচ্ছে । যেমন-
১.কাজিন নাফিসার সাথে খেতে বসা হলো।খাওয়ার টেবিল ঘরে নেই।ছোট পরিবার।এধরণের পরিবার আমার খুব পছন্দের। বিবাহের পর স্বামী স্ত্রী ছোট্ট একটা বাসায় থাকবে।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে স্বামী যখন বাসায় ফিরবে চোখে ঘুম নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকা স্ত্রীর চোখকে ভালবাসা জাগিয়ে দিবে।সে গিয়ে চুলোয় খাবার বসাবে।দুজন রাত সাড়ে বারোটায় খেতে বসবে।খাওয়া শেষে একসাথে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করবে।মেয়েটার চোখে যখন ঘুম চলে আসবে,ছেলেটা তখন তার মাথা নিজের বুকে টেনে আনবে।ঘরে নূতন সন্তান, ভালবাসার ফলাফলকে ঘিরেও থাকবে, সত্য চাহিদা।নাফিসা ক্লাসে আমার চে' একবছরের জুনিয়র, কিন্তু বয়সে দু'মাসের বড়।আমি নাফিসার সাথে বিছানায় খেতে বসেছি।ভাত প্লেটে নেয়া হয়েছে।সামনে মুরগীর মাংস রাখা আছে।এক পিস রান,আর বাকি দুটা ছোট পিস।নাফিসা ভাতে বিচ্ছিরি ভাবে লবণ মাখছে।আমি তার দিকে তাকালাম, তার কোনও ভাবান্তর নেই।ফুপু সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।তিনি আমার প্লেটে মুরগী না তুলে দিলে নাফিসার তুলে দেবার কথা।কিন্তু কেও কিছু করছে না। আমাকে নিজেই মুরগীর মাংস প্লেটে তুলতে হবে।আমি কোন পিস নিবো,তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।আমি মেহমান হিসাবে রানের পিসটা নিজের প্লেটে তুলে নেয়াটা শোভনীয় নয়।রানটা নাফিসার প্লেটে তুলে দেয়া যেতে পারে।তারপর ছোট দু'পিস নিজের প্লেটে তুলে নিব।ছোট দু'পিস নিব, নাকি একপিস নিব, তা নিয়েও কিছুক্ষণ ভাবলাম। দু'পিস নিলে ফুপু হয়তো খুশিই হবে, কিন্তু আমিই ফুপুকে টেনে এনে মনেমনে ভাবব, ছোটলোকের বাচ্চা দু'পিস নিছে কোন লজিকে? মুরগী কেও দু'পিস নেয়? মেহমানদের আরেকটু বিবেচনা করে চলা উচিত। এক পিস নিলেও বিপদ! ফুপু রেগে উঠে বলবেন, কি ভাবিস কি তুই আমাদের? আমরা খেতে পারি না? আয় রান্নাঘরে আয়।দ্যাখে যাবি কত পিস মুরগী রান্না হয়েছে।ঠান্ডা হয়ে যাবে দ্যাখে অল্প অল্প করে আনছি,আর তুই ভাবছিস, কম রাঁধা হয়েছে...! তুই এভাবে ভাবতে পারলি আমাদের ?আমি নাফিসার দিকে তাকালাম। সে এখনও প্লেটে লবণ মেখে যাচ্ছে। ছোট বাটির প্রায় সব লবণই মেখে ফেলেছে।অসভ্য একটা মেয়ে! আমি এ মুহূর্তে কিছু না ভেবে অথবা অনেক ভেবে ছোট একটা পিস নিজের প্লেটে তুলে নিলাম।ফুপু দৌড় দিয়ে এসে আমার হাত থেকে চামচ নিয়ে ফেললেন। আমি নিজের প্লেটে মাংস রাখার আগেই তিনি নিজেই রানের পিসটা প্লেটে তুলে দিলেন।আর নাফিসা তখনও ভাতে লবণ মেখে যাচ্ছে।
২.
আমাকে খেতে বসানো হয়েছে।আমি এখন জেঠাতো বোনের বাসায়। আপুর তিন ছেলে।তারা যথাক্রমে ফাইভ,সেভেন আর এইটে পড়ে।এইটে যে পড়ছে সে এখনও স্কুল থেকে আসে নি।বাকি দুটা টিভিতে কার্টুন দ্যাখছে।দুলাভাই অফিসে।আমি একা খেতে বসেছি।আমার একাকীত্ব দূর করার জন্য আপু তার ছেলে দুটাকে কান টেনে টিভির সামনে থেকে আমার সামনে নিয়ে আসলেন।দাজ্জাল কণ্ঠে বললেন,খেতে বস বাবা।তারা চরম বিরক্ত নিয়ে খেতে বসল।আর একটু পরপর আড়চোখে আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মনেমনে অবশ্যই ভাবছে,আমি কেন শুধু শুধু ওদের বাসায় আসলাম!না আসলে তো ওদের কার্টুন দ্যাখায় ব্যাঘাত ঘটতো না।আমি অপরাধীর মতো বসে রইলাম।সামনে প্লেটে পোলাও রাখা হয়েছে।আপু একটু পর রোস্ট আনলেন।এনেই বত্রিশটা দাঁত বের করে রানের বিশাল পিসটা আমার প্লেটে তুলে দিলেন।পিচ্চি দুটা একসাথে আমার প্লেটের দিকে তাকাল,আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।অপরাধটা অবশ্য আমার নয়, আপুর।ফাইভে পড়া পিচ্চিটা মিনমিন করে বলে উঠল, আমি রান খাব।আমি বিপাকে পড়ে গেলাম।আপু গরম চোখে তার দিকে তাকালেন।বাচ্চাদের নৈতিক শিক্ষা দিতে না পারার ব্যর্থতায় তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারলাম না।আমার প্লেট থেকে রানটা উঠিয়ে তার প্লেটে দেয়া যেতে পারে।আবার তাতে পিচ্চিটা যদি হুংকার ছেড়ে বলে,আমি অন্যকারও পাতের জিনিশ খাই না,তখন...? আমি বুকে সাহস এনে বড় করে একটা দম নিয়ে আমার প্লেটের রানটা পিচ্চিটার প্লেটে তুলে দিতে যাচ্ছি, এমন সময় আপুর কোমল হাত আমার হাতটা ধপ করে ধরে ফেলল।গর্জে উঠে তিনি বললেন,তুই কি ভেবেছিস, রান একটাই রান্না হয়েছে? অবশ্যই না।রান দুটাই রেঁধেছি।মামাগিরি বন্ধ করে চুপচাপ খা।পিচ্চিটা যেন চোখে আলো খুঁজে পেল,আমিও আমার পথ খুঁজে পেয়ে রানে একটা কামড় দিলাম।
৩.
বিয়ের অনুষ্ঠানে খেতে বসেছি।ফুফাতো বোনের বিয়ে।প্রেমের বিয়ে না,ধরে আনা বিয়ে।আমি হাসিমুখে সামনের বড় বাটিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।মুরগীর রোস্ট আসামাত্রই যে যার প্লেটে পছন্দের টুকরো তুলে নিচ্ছে।পরিচিত ভাইবোন ছাড়াও আশেপাশে অপরিচিত মুরব্বিও আছেন।আমি এক পিস রান নিলাম।বিয়েতে নাকি সবার খাওয়া বেড়ে যায়,আমার কমে যায় কেন তা ভেবে আমি নিজেও রোমাঞ্চিত।খাওয়া শেষে অভ্যাস মতো রানের হাড্ডি কামড়িয়ে কামড়িয়ে ভেতরের কালো বস্তুটা (মজ্জা) খেয়ে ফেললাম। পাশের মুরব্বি একজন বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন।বেশী দেরি না করে তিনি বলে ফেললেন, জীবনে রানের হাড্ডি খাও নাই? কোথায় যাচ্ছে এই তরুণ সমাজ...! বিয়ে খাবে, মুরগী খাবে, গরু খাবে, খাসী খাবে,সালাদ খাবে, কোক খাবে,সবজি খাবে, ডিম খাবে,আবার হাড্ডিটাও খাবে।যুব সমাজের ক্ষিধে কি আজকাল এত বেড়ে গেছে? আমরা যুবক ছিলাম না, কি বলেন আপনারা?পাশে অন্য মুরব্বিরা স্লোগান দেয়ার মতো করে বলল, তৈ ছিলাম না নি! মুরব্বি সাপোর্ট পেয়ে আরও ক্ষিপ্র কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন,সারাদিন ক্ষেতখামারে কাজ করে পেঁয়াজ, মরিচ ডলে ভাত খেতাম, আর এই ছেলেটাকে দ্যাখেন, মুরগীর রানের সাথে হাড্ডিটাও চিবায়! কি বেয়াদব ছেলে! পাশে মুরব্বিরা দাঁতের অভাবে শক্ত জিনিশ খেতে পারে না দ্যাখে, আমাদের ভেঙিয়ে হাড্ডি চিবিয়ে কামড়িয়ে আমাদেরকে দ্যাখায়, তার দাঁত আছে।অসভ্য কি! অন্য মুরব্বিরা গম্ভীর চোখে বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন।যেন খাস ইবলিশকে দ্যাখছেন।কেও বলে উঠলেন, প্রযুক্তির অপব্যবহার। কেও বললেন, বদমাশ ছেলে! আমাদের তোমার মতো বয়সে আরও শক্ত দাঁত ছিল।দাঁত দিয়ে সুপারি টুকরা করতাম,নারকেল ছিঁড়তাম; আর উনি মুরগীর রান ছিঁড়ে হিরো হয়ে গেছেন!কেও বিরক্ত মুখে বলল, তার বাবার কানে যাওয়া উচিত।কেও একজন বলে উঠলেন, আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।হাশরের ময়দানে তার দাঁত ভেঙে দেয়া হবে। আমি দাঁত ভাঙা ভুল অপমান গায়ে মেখে আসর ছেড়ে চলে আসলাম। পেছনে একবার ফিরেও তাকালাম না।কোনও এক মুরুব্বি পেছন থেকে বলে উঠলেন, কি বেয়াদব দ্যাখলেন! রান চিবিয়ে উঠে গেছে, সালাম দিয়ে যায় নি।আরেকজন তাকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, পাপী!
৪.
বড় ফুপার বাসায় খেতে এসেছি।আজ কোনও এক ব্যবসা সংক্রান্ত জটিলতায় তার বাসায় বহু মুরব্বির সমাগম। আমাকে মুরগীর রান খেতে দেয়া হলো।আমি হাসিমুখে খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে রানের হাড্ডিতে কামড় বসানোর আগে গতবারের আখিরাতে দাঁত ভেঙে যাবার ভয়ে চুপচাপ হাড্ডিটা না কামড়িয়েই রেখে দিলাম।মুরব্বিরা আমার দিকে তাকালেন। আমি বিজয়ের হাসি হাসলাম।একজন মুরব্বি প্রচন্ড বিরক্ত হলেন।আমার হাসিতে খুব সম্ভব তার পিত্তি জ্বলে গেছে।তিনি রেগে উঠে বললেন, বাহ, এই তাহলে যুব সমাজ...?আধুনিকতা মানে কি? নোংরামি? নষ্টা মেয়ে জাহান্নামি ছেলে...? মুরগী খেয়ে হাড্ডিটা রেখে দিয়ে কি ভাবে তারা? হাড্ডি খেলে হাত গন্ধ হবে? মর্ডাণ ছেলেমেয়েরা হাড্ডি খায় না? সেদিন আমার কলেজ পড়ুয়া মেয়েটা কি বলে জানেন?বলে,হাড্ডি আমি খাই না।আমি কি ক্ষ্যাত নাকি? শুনলেন ভায়েরা, কি বলল? আমরা ছোটবেলায় ক্ষেত খামারে কাজ করেছি, আর আজকের মর্ডাণ ছেলেমেয়েরা শব্দটাকে গালি বানিয়েছে।ইয়া মাবুদ! রহম করো!আমার দাঁত নেই,আলগা দাঁত লাগিয়েও আমি রানের হাড্ডি খাই।আর এ কি ইয়াং সমাজ! হাড্ডি খেতে গিয়ে দাঁতই ভেঙে ফেলে! অথচ আমরা দাঁত দিয়ে ডাব ছিঁড়তাম।কোথায় যাচ্ছে আমাদের যুব সমাজের দাঁত! আমরা কি এমন যুব সমাজ চেয়েছিলাম...? কি বলেন ভায়েরা? চারপাশ থেকে 'ঠিক,কথা সত্য,দারুণ বলেছেন,রহম করো আল্লাহ' স্লোগান ভেসে এল।সাপোর্ট পেয়ে মুরব্বি বলতে থাকলেন, রানের হাড্ডিতে যে কি পুষ্টি, তা কি তারা বোঝে? বুঝলে কি আর হাড্ডি না খেয়ে থাকতে পারত? আমার নাইনে পড়া মেয়েটা কোনও ভাল জিনিশকে দ্যাখে 'আলহামদুলিল্লাহ' না বলে 'জোশ' বলে! কি অদ্ভুত শব্দ! জানেন ভায়েরা...? আমার মেয়েও এই ছেলেটার মতো, রানের হাড্ডি খায় না।যার বুদ্ধি নেই,তার উপর রাগ করতেও বিবেগে বাঁধে।সেদিন আমার মেয়েটা কলেজ থেকে আসছিল বান্ধবীদের সাথে।আমার মেয়ে ছবি তুলছে, আর বাকিগুলো অসভ্য জাহান্নামীর মতো ঠোঁট বাঁকা করে ছবি তুলছে।হঠাৎ আমার মেয়েটা বলে উঠল,দোস্ত Chill! আমি শব্দটা শুনে থতমত খেয়ে জিনিশটা দ্যাখতে জানালার পাশে চুপ করে বসে রইলাম। একটা মেয়ে খুব বিশ্রীভাবে লাফিয়ে উঠল।আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।আমি হার্টের রোগী, এই ধরনের লাফ দ্যাখে যে এখনও এখানে বসে মুরগীর রান খাচ্ছি, তার জন্য আাঠাশ রাকাত শোকরিয়া নামাজ আদায় করেছি।বলে রাখা ভাল, আমার ছোটমেয়েটাও এই ছেলেটার মতো রানের হাড্ডি খায় না।
এরপর থেকে আর কখনওই কেও কোনও অবস্থাতেই আমাকে মুরগীর রান খেতে দ্যাখে নি।
Imran Hossain Emu

No comments:

Post a Comment