Thursday 25 January 2018

একটি শিক্ষণীয় গল্প - বাঘের উপদেশ

একটি শিক্ষণীয় গল্প <=> (বাঘের উপদেশ)"
******************************************
এলেমের জোরই বড় জোর। এলেমের এই শক্তির কারণে মানুষ দুনিয়ার সব-কিছুর উপর কর্তৃত্ত্ব করে থাকে। দুনিয়ার সবকিছুই মানুষের বাধ্য। নিচের ঘটনাটি এই সত্যকে প্রস্ফুটিত করেছেঃ -
:
এক বাঘ ছিলো। জঙ্গলের বাদশাহ্ ছিল সে। বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসল তখন সে তার একটিমাত্র বাচ্চাকে বললোঃ "দেখ বাবা! মিলেমিশে থেক। সবার সাথে সাক্ষাৎ করিও, সবার কাছে যেও কিন্তু এই মানুষ জাতের কাছে যেয়ো না। এই বস্তুটা বড় অত্যাচারী এবং জালেম। যদি কোন সময় তার কাছে যাও তবে তোমার মস্তবড় ভুল হবে। বিপদে পড়ে যাবা।"
:
এই উপদেশ প্রদানের পর জঙ্গলের সেই বাদশাহ্ ইন্তেকাল করলেন। তার মরার পর তার বাচ্চা স্হলাভিষিক্ত হলো। জঙ্গলের বাদশাহ্ হলো এখন সে। বাঘের বাচ্চার অভিজ্ঞতা ছিলো না। সে ভাবলো, "আমার বাপ বলেছিল, 'মানুষের কাছে যেয়ো না, এই জিনিষটা বড়ই জালেম।' সুতরাং দেখা দরকার মানুষ জিনিষটা কী রকম আমার বাপ জঙ্গলের বাদশাহ্ হওয়া সত্ত্বেও এই বস্তুটিকে ভয় পাওয়ার কারণ কী? মনে হয় মানুষের শক্তি খুব বেশী। বাঘ তো দুইগজ লম্বা হয়ে থাকে আর মানুষ মনে হয় দশ গজ, বিশ গজ লম্বা হবে। আসলে জিনিষটা কেমন একটু দেখা দরকার।"
:
কিন্তু তার আশে পাশে যে সকল জীব-জন্তু বাস করতো তারা বললো, 'দেখ ভাই বড়দের উপদেশ মানতে হয়। বাপ বলেছিল মানুষের কাছে যেয়ো না, এইটা বড় জালেম জিনিষ। সুতরাং তুমি মানুষ দেখার ইচ্ছা করিও না। কোন না কোন বিপদে পড়ে যেতে পার।'
:
সে বললোঃ "তা হবে কেন ভাই। কমপক্ষে একবার দেখে নেওয়া দরকার এই জাতটা কেমন।"
:
বাঘের উপদেশ সে মানলো না। মানুষ দেখতে বাহির হয়ে পড়লো। প্রথমেই একটি ঘোড়া দেখতে পেলো। ঘোড়াটি লাফাতে লাফাতে যাচ্ছিল। বাঘের বাচ্চা ভাবলো, মনে হয় এইটাই মানুষ। কারণ আমার বাপ ছিল দেড়গজ লম্বা আর এইটা তারচেয়ে অনেক লম্বা আর উঁচা। দুই-তিনগুণ বড় বলেই আমার বাপ এইটাকে ভয় পেতো। ভয় পাওয়ার কথাই তো বটে। সে ভয়ে ভয়ে ঘোড়ার কাছে গিয়ে বললো, "জনাব, আপনার নামই কি মানুষ?"
:
ঘোড়া বললোঃ "এই কোন জালেম বস্তুর নাম নিয়েছো? আমার সামনে আর কখনও মানুষের নাম নিয়ো না। মানুষ যাকে বলা হয় সে অত্যান্ত অত্যাচারী জীব। আমি অনেক মোটাতাজা এবং শক্তিশালী, কিন্তু তবু মানুষ আমার পিঠে গদি কষে দেয়, আবার তার উপর উঠে বসে। তার হাতে চাবুক থাকে। আমারর পিঠে চাবুকের বাড়ি পড়ে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে হয়রান হয়ে যাই তবু মাহুষ এট জালেম যে তখনও ক্ষান্ত হয় না, চাবুক মারতেই থাকে। তাই সব জিনিসের নাম নিও কিন্তু এই জালেম মানুষটির নাম নিও না। এটা একটা মহা মছিবত।"
:
বাঘের বাচ্চা ভাবলোঃ "হায় আল্লাহ! মানুষ তাহলে কত বড় হবে? এই লম্বা-চওড়া জন্তুটিও মানুষকে ভয় পায়! আর বাপ তো ভয় পেতে পেতে মারাই গেলেন। কী রকম এই ভয়ঙ্কর মানুষটি?"
:
আরও এগিয়ে গেল। হঠাৎ একটি উট চোখে পড়লো। সে ভাবলো এটাই হবে মানুষ। একটি অঙ্গও সোজা নয়। ঘাড় একদিকে, কোমর অন্যদিকে, পা গুলি আরেক দিকে বাহির হয়ে কিম্ভুতকিমাকার আকৃতির এই জন্তুটিই মানুষ হবে, এটা ঘোড়ার চেয়েও চারহাত উঁচা। সে কাছে গিয়ে উটকে বললোঃ "মানুষ কি আপনারই নাম?"
:
উট বললোঃ "আরে লা-হাউলা ওয়ালা-কুউওয়াতা! এই রকম জালেম চীজের নাম নিয়েছো তুমি? এর মত জালেম আর হয় না। এই নাম আমার সামনে উচ্চারণ করিও না। আমি শুধু একাই নই, আমার শত শত ভাই আজ এর হাতে বন্দী। আমার নাকের ডগার ছিঁদ্রের মধ্যে দড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে তারপর সেই দড়ি আমার সামনের ভায়ের লেজে বেঁধে দিয়ে শত শত জনকে সারি বেঁধে মানুষের একটি মাত্র ছোট বাচ্চা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কত কাঁদি, কত বিলাপ করি, কত চিৎকার দিই; কিন্তু মানুষের ছোট একটি বাচ্চা আমাদেরকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মানুষের কথার উপরে শতশত উটের একটি কথাও চলে না। এটা বড় জালেম চীজ। এই নাম আমার সামনেও আর নিয়ো না।"
:
বাঘের বাচ্চা বললোঃ "হায় আল্লাহ! মানুষ কত বিরাট হতে পারে? এতবড় এই জন্তুটি সে-ও মানুষকে ভয় পায়। ঘোড়া তো শুধু নিজের মছিবতের কথা বলেছে আর এটা দেখি তার সকল ভাতৃসমাজের মুছিবতের কথা বয়ান করলো। এক শ' উট এক সঙ্গে মানুষের একটি মাত্র বাচ্চার কাছে বাধ্য হয়ে যায়!"
:
ভয়ে ভয়ে সামনে অগ্রসর হলো। হঠাৎ একটি হাতী দেখতে পেলো। সে ভাবলো, এইটাই মানুষ। কারণ চারটা মোটা মোটা খাম্বার মত উপরে একটি বিল্ডিং এর মত দাঁড়িয়ে আছে, ছাদের উপরে যেন একটি পানির ট্যাঙ্ক রেখে দিয়েছে, সুতরাং মানুষ এইটাই। ভয়ে ভয়ে সে হাতীর কাছে গিয়ে বললোঃ "জনাব, আপনার নামই তবে মানুষ?" মানুষ আপনাকে বলা হয়?"
:
হাতী বললো, "তৌবা আস্তাগফিরুল্লাহ! এ কোন মছিবতের নাম নিয়েছো? আমার সামনে এই নাম আর উচ্চারণ করিও না। এই জিনিষটা বড় জালেম। আমার দেহ বিরাট হতে পারে, দেখতে মনে হয় বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। তা সত্ত্বেও একটি মাত্র বাচ্চা মানুষ আমার পীঠে চড়ে বসে। তারপর তার হাতে লোহার হান্টার থাকে, একটু এদিক-ওদিক করি, সেই লোহার হান্টার আমার মাথায় মেরে দেয়। আমি শুধু কাঁদতে পারি, বিলাপ করতে পারি, আর কিছু করতে পারি না। ঘোড়ার মুখে তবু লাগাম লাগিয়ে সওয়ার হয়। আর আমাকে বিনা লাগামেই কাবু করে ফেলে। লাগামও নাই আবার নাকে দড়িও নাই তবুও আমি মানুষের কাছে বাধ্য হয়ে পড়ি। এই মানুষ একটা আজব চীজ!"
:
বাঘ বললোঃ "হায় আল্লাহ! মানুষ তাহলে কোন জিনিসকে বলবো? যাকেই দেখি সেই মানুষকে ভয় পায়, মানুষের নাম শুনলে কেঁপে উঠে আর বলে, মানুষ বড় জালেম জিনিষ। আমি এখন কোথায় যাবো? কোথায় মানুষ পাবো"?
:
এই বলে সে আরও সামনে অগ্রসর হলো।
:
দশ-বার বৎসর বয়সের এক মিস্ত্রির ছেলে একটা মোটা কাঠ চিরার কাজে ব্যাস্ত ছিল। কাঠের খন্ডটি উঁচুতে এক মাচায় রাখা ছিল। করাত চালাতে সুবিধার জন্য দুই পাশের কাঠ যেন ফাঁক হয়ে থাকে সেজন্য আধা-চিরা কাঠের মাঝখানে একটা কাঠি দিয়ে গোঁজ দিয়ে রেখেছিল।
:
বাঘের বাচ্চা ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে তার সামনের কাঠের খন্ডের উপর বসলো। সে কল্পনাও করতে পারেনি এই ছেলে যে মানুষ। কারণ সে ঘোড়া দেখেছে উঁট দেখেছে এবং হাতী দেখেছে। সবাই মানুষকে ভয় পেয়েছে। এত বড় বড় জন্তু এই ছোট ছেলেটিকে দেখে ভয় পাওয়ার কথা না। সুতরাং এটা মানুষ কল্পনাও হলো না তার। শুধু অণুসন্ধানের জন্য জিজ্ঞাসা করলোঃ "ভাই মানুষ কোথায় পাওয়া যায়?"
:
মিস্ত্রির ছেলে বললোঃ "আমাকেই মানুষ বলা হয়।"
:
বাঘের বাচ্চা বললোঃ "লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা! গজ খানিক লম্বা একটা ছেলে বলছে, আমিই মানুষ! আমার বাপ কি তবে বোকা ছিল যে তোকে ভয় পাবে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি? এক থাপ্পর মেরে তোর কাম সারা করে দিব এখনই!"
:
ছেলেটি ভাবলো, "হাজার হলেও এটা বাঘ। এর সঙ্গে শক্তিতে পারা যাবে না, তর্ক করেও লাভ হবে না। বুদ্ধির জোর না হলে শক্তি দিয়ে এর কাছ থেকে প্রাণে বাঁচা যাবে না। সে দেখলো, যে-কাঠের খন্ডটি সে চিরার সময় একটা গোঁজ ঠুকে দিয়েছিল বাঘের লেজটি তার ফাকে ঢুকে গিয়ে নিচের দিকে ঝুলে আছে। সে বললোঃ "বাঘ মশাই আপনি সব-কিছুই করতে পারেন। আপনি জঙ্গলের বাদশাহ্। আপনার শক্তি আছে, আমার শক্তি নাই। তাই এই গোঁজটি আমি খুলতে পারছি না। যদি আপনার শক্তি দিয়ে এই গোঁজটি খুলে দেন তবে আমার বড় উপকার হয়।"
:
বাঘ বললোঃ "এটা আবার কাজ নাকি?"
এই বলে সে এক থাবা মেরে গোঁজটি খুলে ফেললো। আর ওমনি দুইদিকের চিরা কাঠ চেঁপে এসে বাঘের লেজ আটকিয়ে ফেললো। বাঘের বাচ্চা চি চি করতে লাগলো। লেজ আর ছাড়াতে পারলো না।
:
এদিকে ছেলেটি চিৎকার করে, "বাঘ ধরেছি, বাঘ ধরেছি" বলে গাঁয়ের লোক ডাকতে লাগলো।
মুহুর্তের মধ্য সারা গাঁয়ের লোক জমা হয়ে বাঘের বাচ্চাকে বন্দী করলো লোহার খাঁচায়। মানুষ চেনার আগেই সে মানুষের একটি বাচ্চার হাতে এখন বন্দী। সে এখন মানুষ চিনেছে। কিন্তু এখন আর চিনে কি লাভ? আজ তার রক্ষা নাই। কেউ বল্লম আনলো, কেউ বন্দুক, কেউ দা-বটি, মোটকথা যার কাছে যা ছিলো তাই নিয়ে এসে বাঘের খাঁচা ঘেরাও করলো। আজ সবাই মিলে হত্যা করবে তাকে। আজ তাদের উৎসব।
:
বাঘ বুঝতে পারলো, বাপের উপদেশ না মানার কারণেই আজ আমার এই দুঃখ, এই লাঞ্চনা আর এই মৃত্যু।
*
সুতরাং বাঘের শক্তি পরাজিত হলো। এলেমই বড় শক্তি। এলেমের কাছে সকল শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এলেম সবকিছুকেই জয় করতে পারে।
:
হযরত রসূলে পাক সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ --
ﺍَﻟﻨَّﺎﺱُ ﻛُﻠُّﻬُﻢْ ﻫﺎَ ﻟِﻜُﻮْ ﻥَ ﺍﻻَّ ﺍ ﻟَّﻌَﺎ ﻟِِﻤُﻮْ ﻥَ ★
"যাদের এলেম আছে তাদেরকে ছাড়া সকলই ধ্বংসশীল।"
[খুতবায়ে হাকীমুল ইসলাম, খন্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ২১]
#Collected

No comments:

Post a Comment