Friday 26 January 2018

অমানুষের জন্য মরে যাওয়া যায় না ... সত্যিকারের আপন মানুষগুলোর জন্য বরং বেঁচে থাকা যায় ... প্রচন্ড কষ্ট নিয়েও বেঁচে থাকা যায় !!"

"আমার সাথে যে ফুটফুটে মেয়েটার আজ বিয়ে হতে যাচ্ছে, তার নাম নীলা ... নীলা কে আমি খুব ভালোমত চিনি না ... আমি যতটুকু জানি, বিয়েতে নীলা নিজ থেকেই রাজি হয়েছে, তার বাবা-মা জোর করে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না !!
নীলার চেহারার দিকে তাকালেও বিয়েতে রাজি না হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না ... সে হাসছে ... মোটামুটি আনন্দিত সে ... তার হাত ভরা মেহেদি ... হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছে ... আমি বেশ আশ্বস্ত হলাম !!
খুব ধুমধাম করে নীলার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো ... বিশাল খাওয়া-দাওয়া হলো ... হাজার লোকের সমাগম ছিল ... নীলাকে অসম্ভব রকমের রকমের সুন্দর লাগছিল ... বিয়ের সাজে অবশ্য সব মেয়েকেই সুন্দর লাগে !!
... ... ...
আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো ... বছরখানেক কেটে গেলো ... নীলার গর্ভে একটা ছেলে সন্তান আসলো ... নীলা এখন ভীষণ সুখী একটা মেয়ে ... উহু, ভীষণ সুখী একজন মা !!
... ... ...
নীলার সাথে সংসার করার পুরো ১৩ বছর পর ড্রয়ারের এক কোণে আমি নীলার ডায়রিটা খুঁজে পাই ... ডায়রিতে যে কয়টা লেখা ছিল, সবগুলোই বিয়ের আগের, তারিখগুলো সে কথাই বলে !!
ডায়রির লেখাগুলো পড়ে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, বিয়ের আগে নীলার একটা রিলেশন ছিল !!
ছেলেটাকে নীলা প্রচন্ড ভালোবাসতো ... প্রত্যেকটা লেখার মাঝে অনেক বেশি আবেগের ছাপ ছিল ... ডায়রির বিভিন্ন পাতার ফাঁকে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি ছিল ... খুব সুখী কাপল ছিল তারা !!
নীলা খুব ভালো ছবি আঁকতো ... ডায়রির বেশিরভাগ পাতায় দুটো হাতের ছবি আঁকা ছিল ... খুব শক্ত করে ধরে রাখা দুইটা হাত ... একটা ছবির নিচে লিখা ছিলঃ
"সে সবসময় আমার হাত ধরে রাখে ... খুব শক্ত করে ধরে রাখে ... আমি বললাম, "এমনভাবে হাত ধরে রাখো যেন হাত ছাড়লেই আমি চলে যাবো ??"
সে কপাল কুঁচকে বললো, "হু, ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাবা !!"
আমি হেসে ফেলি ... দিনের বাকি সময়টা আমার হাত খালি খালি লাগে ... প্রচন্ড শূন্য লাগে !!"
নীলার ডায়রির বাকি লেখাগুলা আমি আর পড়তে চাই নি ... আমি শেষ পৃষ্ঠায় গেলাম ... শেষ পৃষ্ঠায় কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটা লাইন লিখা ছিলঃ
"আজকে সে প্রথম এবং শেষবারের মত আমার হাত ছেড়ে দিলো ... আমি কষ্ট পাচ্ছি ... ভীষণ কষ্ট ... এই অবস্থায় একটা মেয়ে আত্মহত্যা করে, ঘুমের ওষুধ খায় কিংবা হাত কাটে ... আমি এগুলার কিছু করবো না ... আমি স্বাভাবিক থাকবো ... ভীষণ স্বাভাবিক ... কেউ কিচ্ছু জানবে না ... কেউ কিচ্ছু বুঝবে না ... শুধু আমি ভেতরে ভেতরে পুড়বো !!
খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে হবে ... তার সাথে না ... অন্য কারো সাথে ... আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে ... আমাকে অন্য কোন একজন এর হাত ধরে বেঁচে থাকতে হবে ... অন্য কোন একজন পাশের বালিশটায় জায়গা করে নিবে ... আমার একটা সন্তান হবে, সে অন্য কোন একজনকে বাবা বলে ডাকবে ... আমি হাসিমুখে থাকবো !!
শুধু আমিই জানবো, কেউ একজন আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল ... কেউ একজন আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছিল ... কেউ একজন আমার কপালের টিপ ঠিক করে দিতো ... কেউ একজন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো ... কেউ একজন খুব সকালে ফোন করে আমার ঘুম ভাঙ্গাতো ... কেউ একজন ফিশফিশ করে রাতে কথা বলতো !!
প্রত্যেকের জীবনে এই "কেউ একজন" থাকে ... কারো কারো ভাগ্য হয় ঐ "কেউ একজন" এর সাথে সারা জীবন থাকার ... আর কারো কারো ভাগ্য হয় "অন্য কোন একজন" এর সাথে সারা জীবন থাকার !!
তবুও জীবন থেমে থাকে না ... আমি, তুমি, "কেউ একজন", "অন্য কোন একজন" সবাই চলতে থাকে ... একদম নিজের মত !!
অনেকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করবে, "কীভাবে তার জায়গাটা তুমি আরেকজনকে দিলা ??"
পৃথিবীতে কেউ কাউকে কারো জায়গা দেয় না ... কেউ কাউকে REPLACE করতে পারে না ... ভাগ্যের দোষে হয়তোবা অন্য কারো হাত ধরতে হয়, কিন্তু হাতের ভেতরটা আর আগের মত উষ্ণ লাগে না ... ভাগ্যের দোষে অন্য কারো সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, কিন্তু নিজের ভেতরটা আর আগের মত সিক্ত হয় না !!
... ... ...
নীলার ডায়রির শেষ লাইনটা পড়া যাচ্ছিল না ... লেখার উপর পানি পড়েছিল সম্ভবত ... কলমের কালি ছড়িয়ে গেছে ... খুব সম্ভবত লেখাটা ছিলঃ
"পৃথিবীর যে কেউ আমার চোখের জলের কারণ হতে পারে ... কিন্তু ঐ "টুপ করে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু" টা কিন্তু একজনই, একজনের জন্যই ... ওটা কখনোই কেউ হতে পারে না, পারবে না ... "টুপ করে গড়িয়ে পড়া অশ্রুটার" কথা কেউ জানে না ... কেউ না !!"
... ... ...
আমার চোখ দুটো ভিজে আসলো ... এক ধরণের অপরাধবোধে আমি ভুগতে থাকলাম ... এই অপরাধবোধ দূর করার কোন উপায় আমার জানা নেই !!
পৃথিবীতে সংসার করতে থাকা অনেকগুলো মেয়ে জীবনের এক পর্যায়ে তীব্র রকমের কষ্ট পেয়েছিল ... কোন এক অমানুষের হাত আকড়ে ধরে হয়তো সে বাঁচতে চেয়েছিল একসময় ... সেই অমানুষ তাকে মৃত্যুর দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল !!
এক সময়ের চঞ্চল, দুরন্তপনা, হাসিখুশি মেয়েটার ভেতরটা খুন হয়ে গেছে সেদিনই ... তবুও সে এখনো বেঁচে আছে ... ভারী পাথরের মত জমাট বাঁধা কষ্ট বুকের ভেতরটায় পুষে রেখে স্বাভাবিক মানুষের মত দিব্যি বেঁচে আছে ... বাবা-মা এর জন্য, স্বামীর জন্য, ফুটফুটে সন্তানের জন্য !!
একটা অমানুষের জন্য হয়তো কষ্ট পাওয়া যায় ... কিন্তু অমানুষের জন্য মরে যাওয়া যায় না ... সত্যিকারের আপন মানুষগুলোর জন্য বরং বেঁচে থাকা যায় ... প্রচন্ড কষ্ট নিয়েও বেঁচে থাকা যায় !!" :)
- মুশফিকুর আশিক

No comments:

Post a Comment