Thursday 25 January 2018

গল্পের সেই জেলে হয়তো লাক্সারি ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।আমাদের বেরুনোর পথ কই!

*"লাক্সারি ট্র্যাপ"!*
এক ব্যাংকার আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কেমন চলছে জীবন?"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেছিলেন: "টাকা তো অনেক কামাই, কিন্তু নিজের জীবনটা কোথায়? সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবধি খাটার পর আরাম করার অবসর কখন পাই?"
সভ্যতার উত্তরণের নামে জীবনটাকে কুরুক্ষেত্র বানানোর যে প্রক্রিয়া সেটা যে শুরু হয়েছিল সেই
কৃষি বিপ্লবের সময় তা জানতে পারলাম
"সেপিয়েন্সঃ এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ হিউম্যানকাইন্ড" পড়ার সময়।
এখানে একটা অধ্যায়ের নাম "লাক্সারি ট্র্যাপ"।জীবনকে আরেকটু সুন্দর করার জন্য, আরেকটু আরাম আয়েশে থাকার জন্য খাটুনি খানিকটা বাড়িয়ে দেয়া এবং এই বাড়িয়ে দেয়া খাটুনি থেকে কখনোই মুক্তি না পাওয়ার নামই লাক্সারি ট্র্যাপ।
আমাদের পূর্বপুরুষরা খাবার সংগ্রহ থেকে যখন খাবার চাষে মনোযোগ দিলেন, তারা ভেবেছিলেন এক জায়গায় থেকে অনেক খাবার উৎপাদন করা গেলে একটু নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। বসে বসে
আরাম আয়েশ করা যাবে। সেই লক্ষ্যে তারা সকাল সন্ধ্যা খাটলেন। ফসল এলো প্রচুর, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানির অনিশ্চয়তা থেকেই গেল আগের মতো। অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আরো বেশী খাটুনি, যাতে উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বছর বছর সন্তান জন্মদান, তাদেরকে সেই কৃষিকাজে নিযুক্ত করা। এই বর্ধিত মুখ যে উদ্ধৃত্ত খাবার খেয়ে ফেলছে, সেই হিসাবটা করতে ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা।
ফলে আগে বনে বাদাড়ে ঘুরে ফিরে সংগৃহীত
খাবারে যাদের চলে যেত; আরাম, আয়েশ, অবসর
মিলত অনেক, তারাই এখন খাটছেন সকাল-সন্ধ্যা। জমি চাষ, রোপন, আগাছা বাছাই, সেচ দেয়া, ফসল কাটা, ঝাড়াই বাছাই এসবই চলতে থাকল বছর জুড়ে। সেই প্রত্যাশিত আরাম-আয়েশ, নিশ্চয়তা আর আসল না! তাই আবার আরো খানিকটা বাড়িয়ে খাটুনি।
আমাদের পেছনে এখন অসংখ্য মোটিভেশন রকেট
ইঞ্জিনের মতো লেগে আছে। খাটো, পরিশ্রম করো, বেশি বেশি আয় করো, উপরে যাও। আমরা অসংখ্য যন্ত্র আবিষ্কার করেছি জীবনকে সহজ করার জন্য, সময় বাঁচানোর জন্য।
মোবাইল ফোন, কম্পিউটার,
ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এসব যন্ত্র
আমাদের যে সময়টুকু বাঁচিয়ে দিচ্ছে, সেই সময়টুকু কই? আমাদের অবসর নাই কেন?আমাদেরকে একটা
ছোট্ট জীবনের জন্য সকাল আটটা থেকে রাত আটটা
অবধি খাটতে হচ্ছে কেন?
প্রতিটি প্রজন্মের পরিবর্তনের সাথে সাথে
আমাদের খাটুনির পরিমান বাড়ছে। আমাদের দাদারা যতটা সময় অফিস করতেন, বাবারা
করেছেন তার চেয়ে বেশি, আমরা খাটছি আরো
বেশি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আরো বেশি খাটবে।
আমরা আটকে গেছি লাক্সারি ট্র্যাপে।
আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই হিসাবের ভুল, সেই কৃষি বিপ্লব নামের ভুল, তারপর অনন্তকাল ধরে আমরা খেটেই যাব!!
সেই জেলে আর ব্যবসায়ীর গল্প আমরা হয়ত অনেকেই
জানি। এক দ্বীপের এক জেলে নিজের নৌকায় করে সকালে সাগরে মাছ ধরে, কিছু নিজের জন্য রাখে, বাকীটা বিক্রি করে সংসার চালায়। দুপুরে ঘুমায়, বিকালে ছেলের সাথে সাগরপাড়ে খেলতে যায়। রাতে জোছনা বিলাস করে।
একদিন সেই দ্বীপে বেড়াতে আসা এক কোটিপতি
ব্যবসায়ীর সাথে জেলের দেখা হল। সেই ব্যবসায়ী
জেলেকে একটা মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে দিল।
-- "তুমি আরো বেশি বেশি মাছ ধরছো না কেন?"
জেলে জিজ্ঞেস করে, "কেন, বেশি মাছ ধরে কী হবে?"
ব্যবসায়ী বলে, "তাতে করে তোমার আরো অনেক বেশী আয় হবে, আরো বড় জাল, আরো বড় নৌকা, আরো বেশী মাছ আরো বেশী আয়। বড় শহরে তোমার অফিস হবে,
বড় ফ্ল্যাটে থাকবা। ছুটি কাটাতে যাবা কোন এক
দ্বীপে। মাছ ধরবা, ছেলের সাথে খেলবা, রাতে
জোছনা বিলাস করবা।...."
জেলে উত্তর দিল, "আমি এখন তো সেটাই করছি।মাছ ধরছি, ছেলের সাথে খেলছি, রাতে জোছনা দেখছি।"
গল্পের সেই জেলে হয়তো লাক্সারি ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।আমাদের বেরুনোর পথ কই!
courtesy : kamrul vai.

No comments:

Post a Comment